পটভূমি ও যৌক্তিকতা
বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন বিগত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে এ অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি ছিল রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার, যা এখন মাটির জৈব পদার্থের ঘাটতি, অণুজীব নিধন, ও পুষ্টি ভারসাম্যহীনতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের অধিকাংশ আবাদি জমিতে মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ ১% এর নিচে, যেখানে টেকসই কৃষির জন্য প্রয়োজন ন্যূনতম ৩%।
এই পরিস্থিতিতে মাটির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার ও টেকসই খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিতে জৈব সার ব্যবহারের প্রসার অপরিহার্য। কিন্তু উৎপাদন ব্যয় ও বাজারমূল্য তুলনামূলক বেশি হওয়ায় কৃষকরা এখনও যথেষ্ট উৎসাহ পাচ্ছেন না। এজন্য সরকারিভাবে জৈব সারে ভর্তুকি প্রদান এখন সময়োপযোগী ও কৌশলগত পদক্ষেপ।
২. উদ্দেশ্য
-
মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করা।
-
মাটির অণুজীব ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করা।
-
কৃষকদের জৈব সার ব্যবহারে উৎসাহিত করা।
-
রাসায়নিক সার নির্ভরতা হ্রাস করে টেকসই কৃষি ব্যবস্থায় রূপান্তর ঘটানো।
-
ফসলের পুষ্টিমান ও খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা।
৩. প্রস্তাবিত পদক্ষেপ
৩.১ ভর্তুকি কাঠামো
-
নিবন্ধিত জৈব সার উৎপাদকদের মাধ্যমে অনুমোদিত পণ্য ক্রয়ে কৃষকদের জন্য ২৫–৪০% ভর্তুকি প্রস্তাব।
-
গ্রামীণ স্তরে কৃষি অফিসের মাধ্যমে ভর্তুকি কার্ড বা ডিজিটাল ভাউচার ব্যবস্থার প্রবর্তন।
-
ভর্তুকির আওতায় শুধুমাত্র সরকার অনুমোদিত ও মানসম্মত জৈব ও অর্গানো-মিনারেল সার অন্তর্ভুক্ত করা।
৩.২ উৎপাদন ও মাননিয়ন্ত্রণ
-
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বিএআরআই/বিএসএমআরএমএ কর্তৃক মান যাচাই।
-
স্থানীয় জৈব উপাদান (গোবর, ফসলের অবশিষ্টাংশ, সমুদ্র শৈবাল, বায়োচার ইত্যাদি) ব্যবহার উৎসাহিত করা।
-
জৈব সার উৎপাদনকারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও স্টার্টআপদের সহজ ঋণ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান।
৩.৩ গবেষণা ও প্রশিক্ষণ
-
মাটি স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে জৈব সারের কার্যকারিতা মূল্যায়নে গবেষণা প্রকল্প চালু করা।
-
কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনী প্লট স্থাপন।
-
Balanced Fertilizer Management ও Integrated Nutrient Management (INM) মডেল বাস্তবায়ন।
৪. প্রত্যাশিত ফলাফল
-
৫ বছরের মধ্যে মাটির জৈব পদার্থের হার গড়ে ০.৫% থেকে ২% এ উন্নীত হবে।
-
রাসায়নিক সারের ব্যবহার ১৫–২০% পর্যন্ত হ্রাস পাবে।
-
ফসলের উৎপাদন ব্যয় কমে যাবে এবং মাটির স্বাস্থ্য উন্নত হবে।
-
কৃষকদের আয় বৃদ্ধি ও পরিবেশগত স্থায়িত্ব নিশ্চিত হবে।
৫. বাস্তবায়নকারী সংস্থা
-
কৃষি মন্ত্রণালয়
-
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (DAE)
-
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI)
-
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (SRDI)
-
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও কৃষি উদ্যোক্তা নেটওয়ার্ক
৬. নীতিগত সুপারিশ
-
জাতীয় বাজেটে “জৈব সার উন্নয়ন ও ভর্তুকি তহবিল” গঠন।
-
জাতীয় মাটি স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার কর্মসূচির সাথে জৈব সার ব্যবহারের সংযুক্তি।
-
প্রতিটি উপজেলায় অন্তত একটি জৈব সার প্রদর্শনী ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন।
-
“Balanced Fertilizer Doctor” উদ্যোগের অধীনে কৃষক পর্যায়ে জৈব সার ব্যবস্থাপনা পরামর্শ প্রদান।
উপসংহার
জৈব সারে ভর্তুকি প্রদান কেবল একটি কৃষি নীতি নয়—এটি টেকসই কৃষি, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং খাদ্য নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ। মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এই নীতি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ কৃষি এক নতুন সবুজ বিপ্লবের পথে অগ্রসর হবে।